গল্পের নাম মুখোশ
ঘুম থেকে ওঠার পর থেকেই শরীর টা খারাপ লাগছে।মনে হয় প্রেসার টা বেড়েছে । কয়দিন ধরে পরিশ্রম যাচছে খুব । ঘুম টাও একটানা হচ্ছে না । দোষ টা নিজের ই । প্রেসার এর ওষুধ খেতে একদমই মনে থাকে না । ইদানীং একটু ধকলেই কেমন যেন হাপিয়ে ওঠি। টানা ৬ মাস ঘাড় আর মাথা ব্যথায় ভূগার পর যেদিন আবিদের সময় হয়েছিল আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার সেদিন ই প্রথম জানতে পেরেছিলাম যে বিপি হাই। ৩২ বছরে বয়সে আমার প্রেসার হাই এটা শুনে ডাক্তারের সাথে সাথে আমিও অবাক হয়েছিলাম খুব। ডাক্তার ভাই আবিদের ক্লাসমেইট হওয়ায় ফান করে বলেছিল এই বয়সে আপনার অত কিসের টেনশান ভাবী ?ভদ্রলোক সেদিন আমার মলিন হাসির আড়ালের হাজার টা কারন পড়তে না পারলেও কিছু একটা টের পেয়েছিলেন নিশ্চয় তাই হয়ত আবিদ কে বলেছিল যে বউকে যত্ন করিস ব্যাটা , তাহলে তুই ও যত্ন পাবি ।কিন্তু আমার ভালো বা খারাপে ওর আরাম আয়েশের যে কোন কমতি হয় না এটা উনি কেন গোটা পৃথিবীর কেও ই হয়ত জানে না।কারন বাইরেই দুনিয়া তে সে পুরাই অন্য মানুষ ।
সকালের চা টা খেতে খেতে ভাবছি আজ যদি দুপুরে একটু শর্টকাট রান্না করতে পারতাম তাহলে ভালো হত , মাথা টা কেমন জানি দপদপ করছে ।কিন্তু পরক্ষনেই যখন আবিদের বিশ্রী চেহারা ডা ভেসে ওঠল যেটা সে পান থেকে চুন খসলেই দেখায় ।
আবিদের নাম টা নিতে নিতেই ওর গলা পাওয়া যাচ্ছে ।
– পুষ্প এই পুষ্প
– বল শুনছি।
আজ আমার এক বন্ধু আসবে নতুন বউ নিয়ে
১২ টার দিকে আসবে কিন্তু দুপুরে খাবে না কারন ওদের অন্যখানে দাওয়াত আছে ।৪/৫ টা নাস্তা র আইটেম রেডি করে ফেলো ।
– আচছা ঠিক আছে ।
আর মেহমানের সামনে যেন সব ঠিকঠাক থাকে।
কথা গুলো বলে কোন উওরের অপেক্ষা না করেই চলে গেল সামনে থেকে ।কিছু একটা বলতে গিয়েও চুপ করে গেলাম । কারন বলে যে কোন লাভ হবে না এটাও আজকাল খুব বুঝি আমি।
ফ্রিজে দুধ চিতল পিঠা ছিল সেটা বের করে আরে দুই তিন আইটেম নাস্তা রেডি করতে করতেই কলিং বেল টা বেজে ওঠল । বেশ হাসিখুশি একটা দম্পতি । ওদের দিকে তাকাতেই নিজের সংসার শুরুর সময় টা মনে পড়ে গেল। তখন আমাদের বাড়ি গাড়ি কিছু না থাকলেও এমন একজন আবিদ ছিল যাকে আমি চিনতাম , জানতাম বিশ্বাস করতাম । মাঝে মাঝে খুব জানতে ইচ্ছা করে ….. কোনটা আসল আবিদ ? এখন যার সাথে আছি ও নাকি যার সাথে যাএা শুরু করেছিলাম সে?
খোলা ডাইনিং , দাখিনের বারান্দা , ছাদ বাগান সহ সবকিছু যখন আবিদ কাউকে ঘুরে ঘুরে দেখায় তখন আমার কাজ হলো মেকি একটা হাসি নিয়ে পিছন পিছন ঘুরা । আজ ও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। নতুন বউটা যে এসব দেখে বেশ মুগ্ধ তা ওর চেহারাতেই ভাসছে । ঘুরতে ঘুরতে যখন ওরা সারভেন্ট কোয়ার্টার এর সামনে এসে দাড়ালো তখন ওরা বেশ অবাক হয়ে বললো … বাহ খুব সুন্দর সিস্টেম ত ।সচরাচর বাড়িতে ত এমন টা দেখা যায় না । যাক ভাবী আপনার ত তাহলে এদের শুয়া পরা নিয়ে আলাদা ভাবে চিন্তা করতে হয় না । ভাই ত খুব ভালো একটা কাজ করেছেন এমন আরো কত কি । এসব প্রশংসা শুনে আবিদের আত্নতৃপ্তির হাসি টা বুকে গিয়ে বাঁধে আমার ।দু পাশের সিরাগুলো দপ দপ করতে থাকে ।অদৃশ্য সকল শিখল ভেংগে চিৎকার করে সবাই কে জানিয়ে দিতে ইচছে করে তোমরা যা দেখছ তা ঠিক না । এই সার্ভেন্ট কোয়ার্টার বানানো হয়েছে তোমাদের কে দেখানোর জন্য কোন সার্ভেন্ট থাকার জন্য না।কারন এ বাড়িতে আমাকেই সার্ভেন্ট হিসেবে বিবেচনা করা হয় তাই আর নতুন কোন সার্ভেন্ট এখানে রাখা হয় না । এ যে হাসি আর সুখ তোমরা দেখছো তার কোনটাই আসল না ।কারন সবার সামনে আমাকে সবসময় সুখী মানুষের অভিনয় করতে হয় এমনকি হঠাৎ শরীর খারাপ হলে বা বললে পরে আমাকে শুনতে হয় যে এ অভিনয় টা না করলে হত না । মনখুলে যাতে কারো সাথে একটু কথা বলতে না পারি তারজন্য আমার মেসেন্জারটা পর্যন্ত আনইন্সস্টল করে দেওয়া হয়েছে.। এই যে দেখছো এতবড় বাড়ি তবুও রেস্ট করার মত একটু জায়গা নেই আমার , আমার ঘর ভর্তি মানুষ আছে কিন্তু শরীর খারাপ হলে মাথায় হাত দেওয়ার কেও নেই। খুব ইচ্ছে করে আধুনিক লেবাসধারী এই পুরুষটার মুখোশ টা খুলে দেই যাতে তোমরা ওর ভিতরের মধ্যযুগীয় বর্বর পশুটা কে চিনতে পার । কিন্তু করি না , করতে পারি না । শূন্য থেকে নিজ হাতে গড়া এই সংসার টার প্রতি খুব যে মায়া জন্মে গেছে। আর ফিরে যাওয়ার পথটাও ত সেদিন বন্ধ করে এসেছিলাম ।
তাই এখন শুধু অপেক্ষা চিরমুক্তির ।
লেখিকা:পরবাসিনী